৮ মার্চ: নারী শ্রমিকরা নেই কেন?
নিউমার্কেটের তিনতলায় একটা কাজে গিয়েছিলাম। দেখলাম কয়েকজন মেয়ে জড়ো হয়ে বেগুনি শাড়ি খুঁজছেন। কেউ কেউ সেই সাথে মিলিয়ে কী গয়না পরবে সেটারও পরিকল্পনা করছিলেন। তাদের সঙ্গে থাকা ছেলেটি রসিয়ে রসিয়ে মেয়েদের বলছিল, ‘মেয়েদের জন্য ৩৬৫ দিনের একটি দিন কিন্তু ছেলেদের জন্য বাকি ৩৬৪ দিন।’

হঠাৎ মনে হলো ৮ মার্চতো আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এই দিনটি এখন অনেকটাই যেন হয়ে গেছে নারীদের বেগুনি রঙের শাড়ি পরে ঘুরে বেড়ানোর দিন। এখন আন্তর্জাতিক নারী দিবস অনেক বেশি আনন্দ, উচ্ছলতার দিন। নারী শ্রমিকের প্রতিবাদের ইতিহাসকে স্মরণ করা এই দিন আমাদের ভাবনা চিন্তায় এখন আর নেই। শুধু পুরুষ নয়, আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি যে সকল নারী এই দিনটিকে বেগুনি শাড়ি পরে উদযাপন করেন তাদের মধ্যে অনেক নারীই জানে না এই দিনটির তাৎপর্য এবং ইতিহাস। কেনইবা এই বিশেষ বেগুনি রং নারী দিবসের সঙ্গে গেঁথে আছে?

কেন এই রং? নারী দিবসের তাৎপর্যের ওপর পোস্টার বা প্রতীকের রং বেগুনি বেছে নেওয়া হয়েছে। বেগুনি রংটা নারীবাদীদের প্রতিবাদের এক ধরনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, এ রং ভেনাসের, যা কিনা নারীরও প্রতীক। বেগুনি নির্দেশ করে সুবিচার ও মর্যাদা, যা দৃঢ়ভাবে নারীর সমতায়নে সংশ্লিষ্ট। অ্যালিস ওয়াকার রচিত ‘দ্য কালার পারপল’ বইটি এর অনুপ্রেরণা। এই বইতে তিনি তুলে ধরেছেন নারীদের অধিকারের কথা। মনে করা হয়, সেখান থেকেই নারীবাদী আন্দোলনের সঙ্গে জুড়ে গেছে এই রংটা। তবে এখন এই রংটার সঙ্গে আন্দোলনের ইতিহাস নেই। আছে করপোরেট বাণিজ্য। নারী দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন বুটিক হাউসগুলো ‘ছাড়’ দিয়ে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, পিছিয়ে নেই কসমেটিকস এবং বিভিন্ন প্রসাধনী বিক্রেতা হাউসগুলোও। কোথাও কোথাও চলে মেহেদি লাগানোর উৎসবও। তবে এখন এটি হয়ে গেছে এমন যে ৮ মার্চ মানে বেগুনি রঙের শাড়ি বিক্রির ঢল, ৮ মার্চেকে কেন্দ্র করে চলে ব্যবসা, চলে নানা ধরনের প্রতিযোগিতা।

অথচ এই দিনটি হওয়ার কথা নারীর দিন, নারীর নির্মিত ইতিহাসের স্মারক হিসেবে স্মরণ করার দিন। সেই ইতিহাস আমাদের জানান দেয় যে, ১৮৫৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরা তাদের কাজের সময় ১২ ঘণ্টা থেকে আট ঘণ্টায় কমিয়ে আনার দাবিতে ও বৈষম্যহীন ন্যায্য মজুরি আদায়ের তাগিদে পথে নামেন। তাদের এ আন্দোলনে আটক হন অনেক নারী শ্রমিক। পরবর্তীতে ১৯০৮ সালে নিউইয়র্কে বস্ত্র শিল্পের নারী শ্রমিকরা কাজের সুস্থ পরিবেশ, সময় ও যোগ্য মজুরির দাবিতে আন্দোলন করেন। জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সেবছর সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। নারীদের সম্মানে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজতান্ত্রিক দল পরের বছর অর্থাৎ ১৯০৯ সালে ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখ জাতীয়ভাবে নারী দিবস পালন করে।

এরপর ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। এতে অংশ নেয় ১৭টি দেশ থেকে আসা ১০০ জন নারী প্রতিনিধি। এতে ক্লারা জেটকিন প্রতি বছর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব দেন। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো ১৯৭১ সালে ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম পালিত হয় নারী দিবস। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় নারী দিবস। সেই থেকে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে।

বারো ঘণ্টা কর্মদিবসের বিরুদ্ধে নারীর আন্দোলনের স্বীকৃতি হিসেবে ৮ মার্চকে স্মরণ করা হলেও এই দিবসে স্মরণ করা হয় না সেই শ্রমিক নারীদের। আর তাই তো নারী দিবসকে কেন্দ্র করে নেওয়া বিভিন্ন আয়োজনের বাইরে থাকেন এই নারীরা। সবশেষ শ্রম গবেষণা জানাচ্ছে দেশের মোট ৩৮ শতাংশ নারী কর্মক্ষেত্রে রয়েছে যদিও এই শ্রমজীবী নারীদের বড় একটা অংশই পোশাক এবং কৃষিখাতে

এবং এখানে এই তথ্য দিয়ে রাখা প্রয়োজন যে ইনফরমাল সেক্টরে নারীর শ্রম এখনও হিসেবের খাতায় ওঠেনি। আমাদের দেশে শ্রমিক নারীদের বেশিরভাগেই কাজ করে ১২ ঘণ্টার বেশি। বিশেষ করে যারা পূর্ণকালীন গৃহশ্রমিক হিসেবে কাজ করে, বাসাবাড়িতে তাদের শ্রমের হিসেব কখনও করা হয় না। অনেক নারীই আসবেন ৮ মার্চ বিভিন্ন সেমিনারে বক্তব্য দিতে, কিন্তু তাদের অনেকের বাড়িতেই গৃহশ্রমিকদের শ্রমের কোনো হিসাব নেই, যে রকম হিসাব নেই দিন চুক্তিতে হিসাব হওয়া নারী শ্রমিকের।

যে কারণে তারা পায় না ঘণ্টা ভিত্তিতে কাজের মজুরি কিংবা শ্রমিক হিসেবে স্বাস্থ্যসেবা। ৮ মার্চ এই সকল নারী শ্রমিকদের কোনো দাবি দাওয়া হাজির করা হয় না। কিংবা সেই শ্রমিক নারীদের নিয়ে খুব কম কর্মসূচিই নেওয়া হয়। যে ইতিহাসের নির্মাতা নারী শ্রমিকরা, তাদের কাছে থেকে ৮ মার্চ ছিনতাই করে নিয়েছে কর্পোরেট নারীরা। অথচ এই দিনটি তাদেরই হওয়ার কথা ছিল, তাদের এই দিনের ওপর সবচেয়ে বেশি আধিকার।

কিন্তু হয়েছে উল্টো। নারীর রং ফর্সাকারী ক্রিমের স্পন্সরশিপে চলে নারী দিবসের নানা অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠানে হাজির হন সমাজের প্রতিষ্ঠিত, উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত শহুরে নারীরা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ৮ মার্চ পালিত হয় দাতা সংস্থাগুলোর পয়সায়। বড় বড় আভিজাত হোটেলের বলরুমে। হয় রংবেরঙের র‌্যালি, সেমিনার, আলোচনা অনুষ্ঠান। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকেও ইদানীং বড়সড় করে পালন করা হয় এই দিনটিকে।

এদিনে টকশোগুলোতে নানা ‘সফল’ নারীদের জীবনগাঁথা ওঠে আসে, ‘সেলেব্রেটি’ নারীদের নিয়ে অনুষ্ঠান হয়, কিন্তু শ্রমিক নারীর জীবন সংগ্রাম এদিনে কোনোভাবেই মিডিয়া কভারেজে আসে না। যারা এই ইতিহাসের নির্মাতা, সেই শ্রমিক নারীদের বেশিরভাগই থাকে না কিংবা তাদের রাখা হয় না এই দিবসকে কেন্দ্র করে নানা আয়োজনে।

তাদের দূরে রেখেই পালন করা হয় তাদের হাতেই তৈরি হওয়া ইতিহাসের এই দিনটি। যার কারণে এই দিবসের আদর্শগত মালিকানা থেকেই ছিটকে পড়ছে। এখন নারী দিবস করপোরেট ব্যবসার হাতে, নানা রকম স্পন্সরশিপ বাক্সে। আর উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত নারীদের সেমিনার আর টকশোর দিন। কিন্তু এই নারী দিবস সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে, জানাতে হবে।

যে নারীর ন্যায্য শ্রম এবং মজুরির দাবিতে সৃষ্টি হয়েছিল ৮ মার্চ, সেই শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি এখনও অনেক দূরের বিষয়। আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২২ পালনের এবারের থিম হলো ‘টেকসই আগামীকালের জন্য আজকের লিঙ্গ সমতা’। ৮ মার্চ হোক সেই নারী শ্রমিকদের জয়গান, শ্রম দুনিয়াতে লিঙ্গীয় সমতা এবং শ্রমিকের ইতহাসকে বার বার স্মরণ করার দিন।

 

কলমকথা/ বিথী